আমি একজন আইনজীবী বলছি
/ posted in: আইন / posted by: A.F.M Shafiullah“যার নাই কোন গতি সেই
করে ওকালতি”
কোন এক সময় ঠাট্টার ছলে কারো মুখ থেকে ভুল ক্রমে বের হওয়া এই কথাটা, আজকের রূঢ় বাস্তবতায় রীতিমত যেনো প্রবাদে পরিনত হয়েছে। বর্তমানে আইনজীবী মানে সাধারন মানুষের কাছে এক তামাশা আর ভুক্তভোগির কাছে আতংক। কিন্তু ব্যাপারটা কখনো এরকম ছিলনা। আইন পেশার এক উজ্জ্বল অতীত আছে; আছে এক মর্যাদাপূর্ণ ইতিহাস।
এ.কে. ফজলুল হক
মহাত্মা গান্ধী
হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দি
মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ্
আব্রাহাম লিংকন
নেলসন মেন্ডেলা
ফিদেল ক্যাস্ত্রো
ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্ট
জন এফ কেনেডি
এই নামগুলো তাদের নিজ গুনে মহাকালের আবর্তনে ইতিহাসের গতিপথের নির্ণায়ক হয়ে আছে। এঁরা সেই অসংখ্য কীর্তিমানের মাঝে অল্প কয়েক জন যাঁরা, শুধু আইনজীবীই ছিলেননা, ছিলেন, নিপিড়ীৎ মানবতার উদ্ধারকর্তা, শোষিত-নিষ্পেষিত মানুষের কণ্ঠস্বর, শোষক ও অত্যাচারির ত্রাস কিংবা, পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙ্গার আন্দোলনরত মানুষের পথ প্রদর্শক।
কোন একক পেশা থেকে এত বেশি সংখ্যক মহান নেতার আবির্ভাবের কারন কিন্তু খুব সাধারণ। একজন সৎ আইনজীবীর দৃঢ়তা, একজন ন্যায় বিচার প্রত্যাশীর কাছে নির্ভরতার আশ্রয়, তাঁর অন্তরভেদি চাহনি অপরাধীর কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক এবং তাঁর অগাধ জ্ঞান ও নানাবিধ শাস্ত্রীয় পাণ্ডিত্যের কারনে সভ্য সমাজের কাছে তিনি আস্থার প্রতীক ও সর্বজন শ্রদ্ধেয়। আর এই গুণগুলোর চর্চাতেই একজন সাধারন মানুষ ধীরে ধীরে একজন নেতায় পরিনত হন। অর্থাৎ, একজন সৎ আইনজীবীর যা দৈনন্দিন জীবনাচার, তাই-ই একজন নেতার প্রাথমিক গুণাবলি। এই মহৎ পেশার মহান ইতিহাসের পিছনের গল্পটা অতি সংক্ষেপে এমনি।
স্বাধীনতার এক দশকের মধ্যে শুরু হওয়া অনেকগুলো রাজনৈতিক পরিবর্তন আমাদের আর্থসামাজিক জীবনে কিছু বড়, ধাক্কা দেয়। মানুষ আশ্রয় নেয়া শুরু করে দুর্নীতি আর প্রতারণার। ১৯৯০ এর কিছু আগে থেকে এই অনাচারের চর্চার রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ শুরু হয়। কারন, সাধারন মানুষের সফলতার একমাত্র মাপকাঠি হয়ে ওঠে অর্থ লাভের পরিমান। সাথে অর্থ লাভের পথ হয়ে ওঠে মূল্যহীন।
সামাজিক অবক্ষয়ের এই সর্বগ্রাসী প্রভাব থেকে আইনজীবীরাও মুক্ত থাকতে পারেননি।
জ্ঞানের অবারিত চর্চার পরিবর্তে তাঁরা অর্জিত জ্ঞানকে কুক্ষিগত করায় মনোযোগী হন। সহপেশাজীবীদের মাঝে সহযোগিতার বদলে তৈরি হয় ঈর্ষা। আইনের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ক্ষতিগ্রস্তকে ন্যায় বিচার পাইয়ে দেয়ার বদলে, তারা আইনের ছিদ্রপথে অপরাধিকে মুক্ত করাকেই প্রাধান্য দেয়া শুরু করেন। আর এই সমগ্র প্রক্রিয়ার প্রধান শিকার হন তরুণ আইনজীবীরা যাঁরা মাত্রই এই মহান পেশাটির উজ্জ্বল ইতিহাস ছাত্র জীবনে পড়াশুনা করে এসেছেন। দুই চোখ ভর্তি স্বপ্ন আর অপার সম্ভা্বনা নিয়ে সাফল্য লাভের বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে আসা এই তরুণদের স্বপ্নভঙ্গ হতে খুব বেশি দেরি হয়না। মহৎ হওয়ার ইচ্ছা বাদ দিয়ে দ্রুত অর্থ প্রাপ্তির নিশ্চয়তায় তারা আশ্রয় নেয়া শুরু করেন, আইনি পথে প্রতারণার। আদালত কক্ষের পরিবর্তে বাইরের আড্ডা তাদের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে। পড়াশুনা করার বদলে সহকর্মীর দুর্বলতাকে প্রচার করে নিজের যোগ্যতা প্রমানের চেষ্টা করেন তারা। অল্প কথায়, এভাবেই এই লেখার প্রথম দুই লাইনের বাক্যটির প্রবাদ হয়ে উঠা।
আমি একজন আইনজীবী। আমার দীর্ঘ চল্লিশোর্ধ বছরের পেশা জীবনে আমি আমার মহৎ পেশার এই ঋণাত্মক বিবর্তনের সাক্ষী। ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবন মিলিয়ে আমি অনেক দুর্ঘটনা, অনেক আন্দোলন ও একটি যুদ্ধ দেখেছি। এবং দেখেছি এগুলো থেকে ফেরত আসা অনেক পঙ্গু-অসহায় মানুষকে। কিন্তু আজ আমার উপলব্ধি বলে, আমার দেখা এই সকল শরীরিক পঙ্গুত্বের তুলনায় ওই সব স্বপ্নভঙ্গ হওয়া তরুণের আত্মার পঙ্গুত্ব অনেক ভয়াবহ। শারীরিক অঙ্গহানির সম্পূরক হিসেবে বিজ্ঞান নকল অঙ্গ তৈরি করেছে। কিন্তু অঙ্গহানি হওয়া আত্মার কোন সম্পূরক নেই। নাতিদীর্ঘ্য আমার এই পেশা জীবন আমাকে দিয়েছে অনেক সাফল্য, প্রভূত সম্মান, হাত ধরাধরি করে এসেছে ব্যর্থতা, দক্ষতা এবং কর্মজীবন ব্যাপী অভিজ্ঞতা। সাথে তৈরি হয়েছে এই পেশার প্রতি অনেক অনেক দায়বদ্ধতা।
আজ আমি আমার সেই দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে সেই সব তরুণকে উদ্দেশ্য করে বলছি, যারা এই মহান পেশাটিকে নিয়ে আজও স্বপ্ন দেখো এবং নিজেকে পেশাটির উপযুক্ত করে তৈরি করতে চাও, আমার দরজা তোমাদের সবার জন্যে খোলা। কঠিন পথটিতে চলতে গিয়ে যদি কখনো তোমাদের কোনো পরামর্শ প্রয়োজন পরে, তাহলে নির্দিধায় আমাকে জানাতে পারো। আমার সমস্ত অভিজ্ঞতা দিয়ে আমি তোমাদেরকে সাহায্য করার চেষ্টা করবো।
যারা সুবিচার প্রার্থী, তাঁদেরকে বলছি। আপনাদের যেকোনো ধরণের প্রশ্ন আমার কাছে জিজ্ঞেস করতে পারেন আমার ব্লগে। আমি আমার সাধ্য মতন উত্তর দেয়ার চেষ্টা করবো। আর এভাবেই এই মহান পেশার মহান ইতিহাসের কাছে একজন আইনজীবী হিসেবে আমার যে, ঋণ, তার কিছুটা হয়তো শোধ করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে।
A.F.M Shafiullah
Defence Lawyer
Jhenaidah.